মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কারও কোনো কটাক্ষ সহ্য করা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘একটি দলের নেত্রী ও তার নেতারা মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দানকারী ৩০ লাখ শহীদের প্রতি কটাক্ষ করেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অপমান করেছে। আমি ঘৃণ্য বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কারও কোনো কটাক্ষ সহ্য করা হবে না। এদের বিরুদ্ধে ঐকমত্য গড়ে তুলুন। আমরা আপনাদের পাশে আছি।’
সরকারের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। ভাষণে তিনি বর্তমান সরকারের দুই বছর ও তাঁর নেতৃত্বাধীন আগের সরকারের পাঁচ বছর এবং অন্যান্য সরকারের আমলের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতি, পৌর নির্বাচন, বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে সহিংসতা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আইনের শাসন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অগ্রগতি, সমুদ্র বিজয়, স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু প্রকল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের নানা পদক্ষেপের বিষয় উঠে আসে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়ন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্ব সহ্য করতে পারে না। মানুষ শান্তিতে থাকবে, হাসিমুখে জীবন যাপন করবে, তা ওদের সহ্য হয় না। ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত দেশে সন্ত্রাস, সহিংসতা শুরু করে। ওই সময় ২৩১ জন আগুনে পুড়ে নিহত এবং পেট্রলবোমায় ১১৮০ জন আহত হয়। এ ছাড়া ২ হাজার ৯০৩টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, ১৮টি রেলগাড়ি ও আটটি লঞ্চে আগুন দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাঁর এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড জনসমর্থন পায়নি। ব্যর্থতার বোঝা নিয়ে আদালতে হাজিরা দিয়ে নাকে খত দিয়ে বাড়ি ফিরে যান।’ বিএনপি-জামায়াতের ‘অনৈতিক অবরোধ’ কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের আটক করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিচারের কাজ চলছে। যারা আপনাদের আপনজনকে কেড়ে নিয়েছে, ক্ষতি করেছে, সেই অপরাধীরা অবশ্যই শাস্তি পাবে।’
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নে বিশ্বে রোল মডেল। দেশ এখন উন্নয়নের ঐতিহাসিক দিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। দল-মত ও বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি সাম্প্রতিক একটি জরিপের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি ২০০৮ সালে বলেছিলাম, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করব। ইতিমধ্যে আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী দেশবাসীকে নিয়ে ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত করব।’
যোগাযোগ খাত: প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের একটা বড় অংশে দেশের যোগাযোগ খাতের নেওয়া নানা উন্নয়ন প্রকল্প এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্থান পায়। তিনি বলেন, ঢাকায় হাতিরঝিল প্রকল্প, কুড়িল-বিশ্বরোড বহুমুখী উড়ালসেতু, মিরপুর-বিমানবন্দর জিল্লুর রহমান উড়ালসেতু, বনানী ওভারপাস, মেয়র হানিফ উড়ালসেতু, টঙ্গীতে আহসানউল্লাহ মাস্টার উড়ালসেতু এবং চট্টগ্রামে বহদ্দারহাট উড়ালসেতু উদ্বোধন করা হয়েছে। মগবাজার-মালিবাগ উড়ালসেতুর নির্মাণকাজ অচিরেই শেষ হবে। ঢাকা উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলছে।
দুদক ও গণমাধ্যম স্বাধীন: শেখ হাসিনা বলেন, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শক্তিশালী করেছে। কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। দুর্নীতি প্রতিরোধে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যম সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ ছিল বাক্-স্বাধীনতা হরণের দেশ, সাংবাদিক নির্যাতনের দেশ। এখন গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীন। সরকারের সমালোচনা করতে পারছে। সরকার নতুন ৩২টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে। জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাসহ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছে। সাংবাদিকদের সহায়তায় এ পর্যন্ত ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিএনপি: প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ওয়াদা ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার। আমরা বিচার করেছি। রায় কার্যকর হচ্ছে। কেউ বিচার বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।’
জনগণ ও বিরোধী দলকে ধন্যবাদ: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ত্রাস, বোমাবাজি উপেক্ষা করে সেদিন আপনারা গণতন্ত্রকে বিজয়ী করেছিলেন। কিন্তু গণতন্ত্র ও উন্নয়ন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্ব সহ্য করতে পারে না। মানুষ শান্তিতে থাকবে, হাসিমুখে জীবন যাপন করবে, তা ওদের সহ্য হয় না।’
বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতীয় সংসদকে সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছি। বিরোধী দলকে ধন্যবাদ। তারা বিভিন্ন বিষয়ে তাদের অভিমত দিচ্ছে, আলোচনায় অংশ নিচ্ছে।’