জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে দ্বিমত তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা থেকে সরকারি দলটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে এই বিভক্তি। এক পক্ষের যুক্তি, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তাই যেকোনো উপায়ে এ নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হবে। তাদের এ দাবির মধ্যেই গতকাল রবিবার উচ্চ আদালত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। বাকি তিন সিটি করপোরেশন রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালের নির্বাচনও সংসদ নির্বাচনের পরে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতাদের মত রয়েছে। তাঁরা বলছেন, ওই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনে।
জানতে চাইলে বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে পরাজয়ের প্রভাব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়বে। কিন্তু বিধি মোতাবেক ওই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারি দলের কিছু করণীয় নেই দাবি করে তিনি বলেন, বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশন নির্ধারণ করে থাকে।
অবশ্য আওয়ামী লীগের আরেক পক্ষের দাবি, ত্রুটিমুক্র সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে মানুষের আস্থা তৈরি হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দল ভরসা পাবে। সর্বশেষ গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এই দ্বিমত প্রকাশ পায়। সেখানে রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের পর আয়োজনের ব্যাপারে মত দেন এক পক্ষের নেতারা। আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্র কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছে।
আগামী ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের কারণে গাজীপুরের নির্বাচন হচ্ছে না। আদালতের কোনো নির্দেশনা না এলে এখন শুধু খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর অক্টোবরের আগেই রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচনী কাজে গাজীপুর ঘুরে এসেছেন। তাঁরা জয়ের ব্যাপারে অনিশ্চয়তার বিষয়টি আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে অবহিত করেন। এরপর গতকাল সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম ও জনশক্তি বিষয়ক সম্পাদক এ টি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজের দায়েরকৃত রিট আবেদনের শুনানি হয়। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও উচ্চ আদালতের নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায়।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিতের খবরে সাধারণ মানুষের মনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার রাজধানীর বনানী অফিসে এক অনুষ্ঠানে রুহুল আমিন হাওলাদার এ মন্তব্য করেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এভাবেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই অন্যান্য সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে এটা সরকারের জন্য ভালো হবে না। নির্বাচন কমিশনের জন্যও তা ভালো হবে না। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় আমি বিস্মিত হইনি। এ ব্যাপারে আমি আগেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম যে ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হবে। সে আশঙ্কাই সত্যি হলো। এর মাধ্যমে সংবিধান লঙ্ঘন করা হলো।’
জানা গেছে, ক্ষমতাসীনরা খুলনাসহ বাকি তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন কিভাবে মোকাবেলা করবে সেই শঙ্কায় রয়েছে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের ভূমিকা পরখ করতে চায় তারা। গত নির্বাচনে খুলনা ও গাজীপুর সিটিতে জয় পেয়েছিল বিএনপি।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শুরু থেকে জয়ের জন্য মরিয়া ছিল। তারা দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র পদটি পুনর্দখল করতে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় মেয়র প্রার্থী চূড়ান্ত করার সময়ই দুই সিটি করপোরেশনে জয়-পরাজয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। জয়ের জন্য গাজীপুরে নতুন প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বাদ পড়েন সিনিয়র নেতা আজমতউল্লাহ। খুলনায় প্রার্থী হিসেবে সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেককে বেছে নেয় আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন বোর্ডের সভায় গাজীপুরে জয়ের ব্যাপারে সরাসরি শঙ্কা প্রকাশ করেন নীতিনির্ধারকদের একজন। তিনি যেকোনো উপায়ে নির্বাচন পেছানো যায় কি না সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনার দাবি জানিয়েছিলেন। তখন দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তাঁকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল, তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা জয়ের চেষ্টা করছি। সে ক্ষেত্রে জনগণ যদি বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে তাহলে জনগণের সেই মতামতকে মেনে নেব।’ নির্বাচনে পরাজিত হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেন তিনি। নাসিম বলেন, অতীতেও খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। আদালতের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, গাজীপুরে বিএনপি প্রার্থীর কোনো অবস্থানই তৈরি হয়নি। সেখানে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নির্বাচন বন্ধ করার ব্যাপারে কেন উদ্যোগী হবে? মাহবুবউল আলম হানিফ জানান, এই মামলাটি (রিট) ২০১৫ সালে করা হয়। গতকাল শুনানি শেষে উচ্চ আদালত নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি বিরোধী মনোভাবাপন্ন প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। নিকট অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যেভাবে শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় ছিনিয়ে আনেন, এবার এর ব্যতিক্রম হয়েছে। তাঁরা অনেক স্থানে কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে পারেননি। যেসব জায়গায় জয়ী হয়েছেন, সেখানে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।