ছোট্ট মেয়ের আবদার মেটাতে মাংসের দোকানে যান আবদুল বারেক। গরুর মাংসের কেজি ৬৮০ টাকা শুনে ফিরে গিয়ে ১৬০ টাকা দরের দেড় কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনলেন তিনি। টাকা দেওয়ার সময় আবদুল বারেক দোকানিকে বললেন, মেয়েটার পছন্দ গরুর মাংস। সেটি কিনলে অন্য কিছু কেনা যাবে না। মুরগির মাংস নেওয়ায় আজও মন খারাপ করবে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের একটি মুরগির দোকানে এমন হতাশার কথোপকথন শোনা যায়। পরে আবদুল বারেক বলেন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ১৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। বাবার টাকা আছে কিনা ছোট্ট মেয়ে তা বোঝে না। ৩৪০ টাকায় আধা কেজি গরুর মাংস কিনলে একবেলা কোনো রকম চলবে। মুরগি একটু বেশি পাওয়া গেছে। এক ডজন ডিম নিয়েছি, তিন-চার দিন খাওয়ানো যাবে।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় আবদুল বারেকের মতো স্বল্প ও মধ্যম আয়ের অনেকে বাজারে গিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করছেন। ক্রেতাদের কাটছাঁট সমীকরণে মাংস ও মাছের বিক্রি অনেক কমে গেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
বাজার ঘুরে গতকাল প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৬০ থেকে ১৬৫ ও সোনালি মুরগি ২৯০ থেকে ৩১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রুই মাছ মানভেদে ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি, পাঙাশ ১৫০ থেকে ১৬০ ও তেলাপিয়া ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
মাংস বিক্রেতারা জানান, করোনার সময় বিক্রি তলানিতে নেমেছিল। এরপর কিছুটা বাড়লেও মাসখানেক ধরে বিক্রি আবার কমে গেছে। কোনো কোনো মাংসের দোকানে মাস ব্যবধানে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিক্রি কমে গেছে। মাছ বিক্রেতাদের ভাষ্য, দুই সপ্তাহ ধরে ক্রেতার আনাগোনা কমেছে। যাঁরা আসছেন, পরিমাণে কম কিনছেন। বাজারে চাল, আটা, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে মানুষ মাছ-মাংসে কাটছাঁট করছেন।
কারওয়ান বাজারের আল মদিনা মুরগির আড়তের মালিক মো. মিন্টু বলেন, আগের চেয়ে বিক্রি কমে গেছে। আগে যারা ১০ কেজি মুরগি কিনতেন, এখন কিনছেন ৬ কেজি। পরিচিত ক্রেতারা আগে প্রতি সপ্তাহে দুই-এক কেজি কিনতে আসতেন, এখন দুই সপ্তাহেও একবার আসছেন না। তিনি আরও বলেন, দিনে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। ছুটির দিনে কিছুটা বাড়ে। কিন্তু গতকাল ১২ হাজার টাকার মুরগি বিক্রি হয়েছে।
কারওয়ান বাজারের জাহাঙ্গীর মাংস দোকানের বিক্রয়কর্মী মো. সিদ্দিক উল্লাহ বলেন, সাধারণ পরিবারের পক্ষে এক কেজি গরুর মাংস কিনে খাওয়া সত্যিই কঠিন। সব জিনিসের দাম বাড়লেও রোজগার বাড়েনি। ৬৫০ টাকায় এক কেজি মাংস কিনলে একটি পরিবারের একবেলাও হয় না। আরেক বিক্রয়কর্মী মো. খবির উদ্দিন বলেন, মানুষের কেনার ইচ্ছা তো আছে। কিন্তু আয় তো কমে গেছে। একজন লোকের আয় ১০ হাজার টাকা। বাসা ভাড়ায় খরচ ৭ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে মানুষ মাংস খাবে কেমনে?
তেজকুনিপাড়ার মাংস দোকানি মো. মজনু বলেন, মাসখানেক ধরে বিক্রি কম। আগে এই মহল্লায় দৈনিক ৬০ থেকে ৭০ কেজি মাংস বিক্রি করতাম; কিন্তু এখন ৫০ কেজিও হচ্ছে না। গত এক মাসে অন্তত ২০ শতাংশ বিক্রি কমেছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, এত উচ্চ মূল্যে মানুষ এখন আর মাংস খেতে চান না। বিক্রি একেবারে কমে গেছে। গত বছরের ব্যবধানে বিক্রি কমেছে ২৫ শতাংশ। তবে সম্প্রতি এ বিক্রি একেবারে তলানিতে নেমেছে। মোট চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ গরু জবাই হচ্ছে।
তিনি বলেন, অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়ায় একান্ত প্রয়োজন এবং সক্ষম পরিবার ছাড়া কেউই মাংস কিনছেন না। মাংসের ক্রেতা কমে যাওয়ায় ডিম ও মুরগির দাম বাড়ছে।